
পাভেল ইসলাম মিমুল, নিজস্ব প্রতিবেদক :-
রাজশাহীতে ছাত্র-জনতার ওপর ৫ আগস্টের ভয়াবহ হামলার পর দেশজুড়ে যখন ন্যায়বিচারের দাবি উঠেছে, ঠিক সেই সময়েই সবচেয়ে বিতর্কিত বাস্তবতা হয়ে দাঁড়িয়েছে—অভিযোগের কেন্দ্রে থাকা মো: শামিম হোসাইন চৌধুরীর বহাল তবিয়তে সরকারি চাকরি।
ভিডিও, ছবি ও প্রত্যক্ষ অভিযোগের পরও ফ্যাসিস্ট ও স্বৈরাচার আওয়ামী লীগ সরকারের দোসর হিসেবে অভিযুক্ত এই ব্যক্তি এখনো রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী রেজিস্ট্রার পদে দায়িত্ব পালন করছেন, যা নিয়ে ক্ষোভ ও বিস্ময় ক্রমেই রূপ নিচ্ছে তীব্র জনরোষে।
শামিম হোসাইন চৌধুরী রাজশাহী নগরীর টিকাপাড়া এলাকার মরহুম জহির হোসেনের ছেলে।
তার বড় ভাই মাহতাব হোসেন চৌধুরী রাজশাহী নগর আওয়ামী লীগের সাবেক শ্রম বিষয়ক সম্পাদক,রাসিকের ২৩ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর ও রাজশাহী জেলা মোটর শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক।
এই রাজনৈতিক পরিচয় ও ক্ষমতার বলয়ই কি তাকে আজ পর্যন্ত অদৃশ্য ঢাল হয়ে রক্ষা করে চলেছে-সেটিই এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন।
৫ আগস্ট রাজশাহীতে চলমান ছাত্র আন্দোলনের সময় ছাত্রদের ওপর সংঘটিত হামলার ভিডিও ও স্থিরচিত্র সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়। ওইসব ভিডিওতে হামলার স্থলে শামিম হোসাইন চৌধুরীর উপস্থিতি এবং হামলার সঙ্গে প্রত্যক্ষ সম্পৃক্ততার অভিযোগ ওঠে।
ছাত্রদের ওপর লাঠিচার্জ ও সহিংসতার দৃশ্য দেশজুড়ে আলোড়ন তুললেও বাস্তবতা হলো-এখনো পর্যন্ত তার বিরুদ্ধে কোনো দৃশ্যমান প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেই।
সাধারণ নিয়ম অনুযায়ী এমন গুরুতর অভিযোগ উঠলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে অন্তত সাময়িক বরখাস্ত করে তদন্তের আওতায় আনার কথা।কিন্তু শামিম চৌধুরীর ক্ষেত্রে ঘটছে ঠিক উল্টোটা। তিনি নিয়মিত অফিস করছেন,দায়িত্ব পালন করছেন এবং প্রশাসনিক ক্ষমতার অংশ হিসেবেই বহাল রয়েছেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে-বাইরে এখন প্রকাশ্যেই প্রশ্ন উঠছে-আইন কি সত্যিই সবার জন্য সমান,নাকি রাজনৈতিক পরিচয় থাকলে বিচার থেমে যায়?
বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক শিক্ষক ও কর্মকর্তা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন,অভিযুক্ত একজন ব্যক্তি যদি কোনো ধরনের তদন্ত ছাড়াই বহাল থাকেন, তাহলে তা শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তিকেই ক্ষতিগ্রস্ত করে না, বরং শিক্ষার্থীদের মনে রাষ্ট্র ও আইনের প্রতি চরম অনাস্থা তৈরি করে।
একজন শিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, প্রশাসনের এই নীরবতা ভবিষ্যতে আরও বড় সংকট ডেকে আনতে পারে।
এদিকে শামিম হোসাইন চৌধুরীর নামে টিকাপাড়া এলাকায় নির্মিত বিলাসবহুল বাড়ি নতুন করে বিতর্কে আগুনে ঘি ঢেলেছে।
স্থানীয়দের ভাষ্য অনুযায়ী,বাড়িটির ব্যয়,নকশা ও অভ্যন্তরীণ সাজসজ্জা একজন সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয় কর্মচারীর আয়ের সঙ্গে কোনোভাবেই সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এলাকাবাসীর মুখে মুখে এখন একটাই কথা-এটি কি শুধুই সরকারি চাকরির আয়ে সম্ভব?
একজন স্থানীয় বাসিন্দা বলেন,বাড়ির ভেতরে ঢুকলে মনে হয় কোনো অভিজাত প্রাসাদে প্রবেশ করেছি। এমন নির্মাণ একজন সরকারি কর্মচারীর পক্ষে সম্ভব-এই কথায় কেউই বিশ্বাস করতে পারছে না। এই সম্পদের উৎস নিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনের তদন্ত দাবি এখন ক্রমেই জোরালো হচ্ছে।
৫ আগস্টের ঘটনার পর থেকে ছাত্রদের ক্ষোভও ক্রমাগত বাড়ছে। এক শিক্ষার্থী বলেন,আমরা রাস্তায় হামলার শিকার হয়েছি,আমাদের সহপাঠীরা আহত হয়েছে। অথচ অভিযুক্ত ব্যক্তি এখনো নিরাপদে চাকরি করছে। এতে ন্যায়বিচার শব্দটাই অর্থহীন হয়ে পড়ে।
অভিযোগের বিষয়ে মো: শামিম হোসাইন চৌধুরী নিজেকে নির্দোষ দাবি করে বলেন, ভাইরাল ভিডিও ও ছবির ব্যক্তি তিনি নন এবং ৫ আগস্ট তিনি অফিসে ছিলেন। তিনি কোনো রাজনৈতিক পদে নেই বলেও দাবি করেন এবং তার বিরুদ্ধে কোনো মামলার নোটিশ তাকে দেওয়া হয়নি বলে জানান।
এবিষয়ে জানতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (রাকসু) ভিপি মোস্তাকুর রহমান জাহিদ ও জিএস সালাহউদ্দীন আম্মার কে একাধিকবার ফোন দিলে ফোন
রিসিভ করেন নি কোন বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
বোয়ালিয়া থানার অফিসার ইনচার্জ মো: রবিউল ইসলাম বলেন,আইনের চোখে অপরাধী শুধু অপরাধী।এজাহারভুক্ত আসামিদের বিষয়ে তদন্ত চলছে এবং অভিযোগের সত্যতা পেলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) প্রফেসর মোহাম্মদ মাঈন উদ্দিন কে একাধিকবার ফোন দিলে ফোন রিসিভ করেন নি মন্তব্যে পাওয়া যায়নি।
রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশের মিডিয়া মুখপাত্র উপ-পুলিশ কমিশনার গাজিউর রহমান বলেন,
মামলাটি যথাযথভাবে তদন্তপূর্বক যাদের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যাবে তাদের সবাইকে গ্রেফতার পূর্বক তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করা হবে।
তবে বাস্তবতা হলো-৫ আগস্টের রক্তঝরা ঘটনার পর দীর্ঘ সময় পেরিয়ে গেলেও দৃশ্যমান বিচার নেই, নেই জবাবদিহি। রাজশাহীবাসীর প্রশ্ন এখন আর ফিসফিসে নয়, তা স্পষ্ট ও উচ্চকণ্ঠ-অভিযুক্ত হয়েও কীভাবে একজন ব্যক্তি সরকারি চাকরিতে বহাল থাকেন, কোটি টাকার সম্পদের মালিক হন, আর প্রশাসন নির্বিকার থাকে? এই প্রশ্নের জবাব না এলে ক্ষোভ যে আরও বিস্ফোরক আকার নেবে, সেটাই এখন সময়ের সবচেয়ে বড় সতর্কবার্তা।