
ভোরের শিশিরভেজা ঘাস, ঝরে পড়া শিউলি ফুল, ধান পাতার ডোগায় জমে থাকা শিশিরবিন্দু-যেন ছোট ছোট মুক্তার কণা এবং সকাল ও সন্ধ্যার ঠাণ্ডা হাওয়া সব মিলিয়ে বাংলাদেশে শীতকাল প্রকৃতির এক মধুর সময়। তবে দিনের আলো নিভে গেলে সকাল ও বিকেলের মিষ্টি হালকা ঠান্ডা বাতাস জানান দেয় শীতের বার্তা। এ সময় প্রকৃতি যেমন নতুন সাজে সেজে ওঠে, তেমনি আবহাওয়া হয়ে উঠে শুষ্ক ও ঠান্ডা। রোদের নরম ছোঁয়া ও মাঠে শীতের ফসলের সুবাস সবকিছুই এক অন্যরকম সৌন্দর্যে ভরপুর। অনেকের জন্য এটি আরামদায়ক হলেও শিশুদের জন্য শীতকাল অনেক সময় কষ্টকর হয়ে দাঁড়ায়। শিশুর রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা তুলনামূলকভাবে দুর্বল থাকে। শীতের হাড়কাঁপানো ঠান্ডা, ধুলাবালি আর খাবারের অনিয়ম শিশুর কোমল জীবনে বিভিন্ন শারীরিক জটিলতা ডেকে আনে। অথচ একটু যত্ন, সচেতনতা ও ভালোবাসা তাদের শীতের দিনগুলোকে করে তুলতে পারে নিরাপদ, আরামদায়ক ও আনন্দময়।
শিশুর শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা প্রাপ্তবয়স্কদের তুলনায় অনেক কম। সামান্য ঠান্ডা বাতাস বা ধুলাবালিতেই তারা অসুস্থ হয়ে পড়ে। শীতকালে শিশুদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দেখা যায়, সর্দি-কাশি, ইনফ্লুয়েঞ্জা, নিউমোনিয়া, ব্রংকাইটিস, শ্বাসকষ্ট, হাঁপানি বা অ্যালার্জি, ত্বক শুষ্কতা, র্যাশ বা চুলকানি, ঠান্ডাজনিত জ্বর, গলায় ও কানে ব্যথা। বিশেষ করে সচেতনতার অভাবে গ্রামীণ ও দরিদ্র পরিবারের শিশুরা এসব রোগে বেশি ভোগে। তাদের পোশাক, খাবার ও বাসস্থানে উষ্ণতার অভাব থাকে। শীতের সময় পরিবারের সচেতনতা ও দায়িত্ববোধই পারে শিশুকে এসব ঝুঁকি থেকে রক্ষা করতে। সঠিক পোশাকই শিশুর প্রথম সুরক্ষা। অনেকেই মনে করেন শিশুকে বেশি বেশি কাপড় পরালেই সে ঠান্ডা লাগবে না। কিন্তু অতিরিক্ত কাপড় শিশুর শরীরে ঘাম জমিয়ে উল্টো সর্দি-কাশির কারণ হতে পারে। তাদের পোষাকে একাধিক হালকা স্তর দিন, যাতে প্রয়োজনে খুলে ফেলা যায়। চুলকানি বা অ্যালার্জি সাবধানতায় সুতির বা উলের নরম কাপড় ব্যবহার করতে হবে। মাথা, কান, হাত ও পা ঢেকে রাখতে হবে, যেন শরীরের তাপ দ্রুত বেরিয়ে না যায়। শিশুর কাপড় ভিজে গেলে দ্রুত বদলে দিন। অধিকাংশ ক্ষেত্রে মায়েরা জানেন না যে শিশুর পায়ের পাতার মাধ্যমে অনেক তাপ বেরিয়ে যায়। তাই রাতে ঘুমানোর সময় মোজা পরানো খুবই জরুরি।
সূর্যের আলো প্রাকৃতিক ওষুধ। শীতকালে সূর্যের আলো কিছুটা ম্লান হলেও, এটি শিশুর স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী। সকালে আটটা থেকে দশটার মধ্যে শিশুকে সামান্য সময়ের জন্য রোদে রাখলে শরীরে ভিটামিন ডি তৈরি হয়, যা হাড় ও দাঁত মজবুত করে এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। রোদে রাখার সময় খেয়াল রাখতে হবে শিশুর মুখে বা চোখে যেন, সরাসরি রোদ না পড়ে। শীতে শিশুর খাওয়ার রুচি অনেক কমে যায়। এজন্য শিশুর খাবারে থাকতে হবে পর্যাপ্ত পুষ্টি ও উষ্ণতা। পুষ্টিকর খাবারই শিশুর শক্তির উৎস। দুধ, দই ও ডিম শিশুর শরীর গরম রাখে এবং প্রোটিন সরবরাহ করে। কমলা, পেয়ারা, আপেল, গাজর ও পাতা শাক-সবজি ভিটামিন ‘সি’ সমৃদ্ধ, যা ঠান্ডা প্রতিরোধে সহায়তা করে। খিচুড়ি, স্যুপ বা দুধভাত শিশুর জন্য সহজপাচ্য ও পুষ্টিকর। শীতে তৃষ্ণা কম পেলেও শিশুর শরীরে পানির ভারসাম্য রক্ষা করা দরকার। মা যদি বুকের দুধ খাওয়ান, তবে তার নিজের পুষ্টিও সমান গুরুত্বপূর্ণ। মায়ের দুধই নবজাতকের সবচেয়ে নিরাপদ পুষ্টি ও রোগ প্রতিরোধের উৎস। শীতকালে অনেক সময় অভিভাবকরা ঘরোয়া চিকিৎসায় সন্তুষ্ট থাকেন, যা অনেক ক্ষেত্রে বিপজ্জনক হয়ে ওঠে। শিশুদের ওষুধ, ইনহেলার বা কফ সিরাপ কখনোই চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া দেওয়া উচিত নয়।
শীতে অনেক সময় শিশুকে গোসল করাতে ভয় পান অভিভাবকরা। তবে সম্পূর্ণ গোসল না করালেও নিয়মিত শরীর পরিষ্কার রাখা দরকার। শিশুকে কুসুম গরম পানিতে স্পঞ্জ বাথ বা গোসলের পর দ্রুত শুকিয়ে উফ কাপড় পরিয়ে দিন। ত্বক আর্দ্র রাখতে তেল ব্যবহার করুন। শিশুর হাত, মুখ ও কান নিয়মিত পরিষ্কার করুন। শিশুর যত্নের জন্য শুধু পোশাক নয়, বাসার পরিবেশও গুরুত্বপূর্ণ। ঘর পরিষ্কার, শুকনো ও ধুলামুক্ত রাখুন। বাতাস চলাচল করার জন্য জানালা দিনের বেলা কিছু সময় খোলা রাখুন। রাতে ভারী কম্বল নয়, হালকা ও নরম কম্বল দিন, যাতে শ্বাস নিতে সুবিধা হয়। নবজাতকের ঘরের তাপমাত্রা ২৫ থেকে ২৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে রাখার চেষ্টা করুন। শীতের সকালে ধোঁয়া, ধুলাবালি ও কুয়াশায় বাতাস দূষিত হয়ে শিশুদের শ্বাসযন্ত্রে সংক্রমণ হতে পারে। শিশুকে কুয়াশায় বাইরে নিতে হলে স্কার্ফ বা মাস্ক ব্যবহার করুন। যদি কাশি বা শ্বাসকষ্ট দেখা দেয়, চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কোনো ওষুধ দেওয়া যাবে না। শীতকালে দিন ছোট হয়, শিশুরা অনেক সময় ঘরে বন্দি থেকে একঘেয়েমিতে ভোগে। তাই পরিবারের উচিত-শিশুর সাথে গল্প করে, খেলাধুলা করে ও গান গেয়ে হাসিখুশি ও মানসিকভাবে উজ্জ্বল রাখা। ভালোবাসার স্পর্শই পারে শিশুকে সবচেয়ে উষ্ণ রাখতে। একটি সুখী শিশুর রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা সবসময় শক্তিশালী হয়।
বাংলাদেশ সরকার শিশুস্বাস্থ্য, পুষ্টি, টিকাদান ও জনস্বাস্থ্য সুরক্ষায় শীতকালকে একটি বিশেষ মৌসুম হিসেবে বিবেচনা করে থাকে। প্রতি বছর শীত মৌসুমে সরকার শিশুদের ঠান্ডাজনিত রোগ, শ্বাসকষ্ট, নিউমোনিয়া, ঠান্ডা-জ্বর ও পুষ্টিহীনতা প্রতিরোধ করতে নানা ধরণের পদক্ষেপ গ্রহণ করে। জাতীয় শিশুস্বাস্থ্য ও টিকাদান কর্মসূচি (ইপিআই) সারা বছর চললেও শীত মৌসুমে নিউমোনিয়া ও ইনফ্লুয়েঞ্জার প্রকোপ বেড়ে যাওয়ায় বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়। প্রতি বছর দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়, সমাজসেবা অধিদপ্তর ও স্থানীয় প্রশাসনের মাধ্যমে দরিদ্র পরিবারে শীতবস্ত্র, কম্বল বা উষ্ণ পোশাক ও শিশু খাদ্য বিতরণ করা হয়। কমিউনিটি ক্লিনিক, ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্র ও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে শিশুর শ্বাসকষ্টের জন্য ইনহেলার, স্যালাইন ও অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ মজুত রাখা হয় এবং উত্তরাঞ্চলে বিশেষ মেডিকেল টিম গঠন করা হয়। স্কুল ফিডিং প্রোগ্রামে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিশুদের পুষ্টিকর খাবার দেওয়া হয়। মায়েদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় কীভাবে শীতকালেও শিশুর খাবার স্বাস্থ্যকর ও গরম অবস্থায় পরিবেশন করতে হয়। স্কুলে সকালবেলার সময়সূচি পরিবর্তন করে দেরিতে