
নয়ন হোসেন,নিজস্ব প্রতিবেদক:
বুধবার ৩ ডিসেম্বর ঠাকুরগাঁওয়ের গৌরবের দিন পাক হানাদারমুক্ত দিবস অনুষ্ঠিত হয়েছে।১৯৭১ সালের এই দিনে দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ ও মুক্তিকামী মানুষের দুর্বার প্রতিরোধের মধ্য দিয়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে পরাজিত করে স্বাধীনতার পতাকা উড়েছিল ঠাকুরগাঁওয়ে। তখন ঠাকুরগাঁও ছিল দিনাজপুর জেলার একমাত্র মহকুমা; বর্তমানে ঠাকুরগাঁও-পঞ্চগড় মিলিয়ে ১০টি থানার সমন্বয়ে গঠিত ছিল এই বিস্তীর্ণ অঞ্চল।
নভেম্বরের শেষ দিক থেকেই এ অঞ্চলে মুক্তিযোদ্ধাদের তীব্র প্রতিরোধে দুর্বল হয়ে পড়তে থাকে হানাদার বাহিনী। পঞ্চগড় ২৯ নভেম্বর শক্রমুক্ত হওয়ার পর তাদের মনোবল ভেঙে পড়ে। এরপর তারা ঠাকুরগাঁওয়ে অবস্থান নিলেও মুক্তিযোদ্ধাদের আঘাতে ২ ডিসেম্বর রাতেই পিছু হটে ২৫ মাইল এলাকায় আশ্রয় নেয়। অবশেষে ৩ ডিসেম্বর ভোরে সম্পূর্ণভাবে শক্রমুক্ত হয় ঠাকুরগাঁও শহর।
২৫ মার্চ গণহত্যার কালরাতে হানাদাররা ঝাঁপিয়ে পড়ে ঠাকুরগাঁওয়ের নিরীহ মানুষের ওপর—হত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগে বিপর্যস্ত হয় জনপদ। ১৫ এপ্রিল আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত পাকিস্তানি সেনারা দখলে নেয় পুরো মহকুমা। ছাত্রনেতা আহাম্মদ আলী, ইয়াকুব আলী, মাজারুল, দবিরুল ইসলাম, নুরুজ্জামান ও সিরাজউদ্দীনকে আটক করে নির্মমভাবে হত্যা করে টাঙ্গন নদীর পাড়ে ফেলে রাখা হয়—যেখানে আজ বধ্যভূমি স্মৃতি সংরক্ষণাগার দাঁড়িয়ে আছে।
ঠাকুরগাঁও ৬ নম্বর সেক্টরের আওতাধীন ছিল, যার কমান্ডার ছিলেন স্কোয়াড্রন লিডার এম. খাদেমুল বাশার। প্রায় ১০ হাজার মুক্তিযোদ্ধা এই সেক্টরে যুদ্ধ করেছেন। হানাদাররা এ অঞ্চলের বিভিন্ন স্থানে চালায় গণহত্যা—সদর উপজেলার জাঠিভাঙ্গা গ্রামে প্রায় ৩ হাজার গ্রামবাসীকে হত্যা করা হয় স্থানীয় দোসরদের সহায়তায়। ফাড়াবাড়ীতে শেখ শহর আলী, শেখ বহর আলীসহ ১৯ জন নিরীহ মানুষকে ধরে এনে হত্যা করে কূপে ফেলে দেয়।
রাজাকার, আলবদর ও আল শামস বাহিনীর সহযোগিতায় পাকবাহিনী ঠাকুরগাঁওয়ে শতাধিক স্থানে চালায় নৃশংস হত্যাযজ্ঞ। এর বিপরীতে সংগঠিত হয় মুক্তিযোদ্ধা ও জনতার প্রতিরোধ। অবশেষে ৩ ডিসেম্বর হানাদারবাহিনীর পতনের মধ্য দিয়ে ঠাকুরগাঁওজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে মুক্তির আনন্দ। সকাল থেকে শহরের পথে পথে বের হয় বিজয় মিছিল; স্বাধীনতার জয়ধ্বনিতে মুখরিত হয়ে ওঠে জনপদ।
ঠাকুরগাঁও হানাদারমুক্ত দিবস উপলক্ষে জেলা প্রশাসন, জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন দিনব্যাপী আলোচনা সভা, র্যালি, পুষ্পস্তবক অর্পণসহ নানা কর্মসূচি গ্রহণ করেছে।
স্বাধীনতার স্মৃতি, ত্যাগ ও গৌরবের এই দিনটি ঠাকুরগাঁওবাসীর হৃদয়ে আজও সমুজ্জ্বল।